বিটিবি নিউজ: পৃথিবীর বুকে আল্লাহর যত সৃষ্টি রয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো মানুষ, যাদের জন্য আল্লাহ তাআলা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সম্বলিত গ্রন্থ ‘কুরআনুল কারিম’ নাজিল করেছেন। তাদের প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহিতার বিষয়টিও সুনিশ্চিত করেছেন। পরকালীন জীবনে কোনো আদম সন্তানই জবাবদিহিতা ছাড়া এক কদমও নাড়াতে পারবে না বলে বিশ্বনবি (সা.) ঘোষণা করেছেন।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। (তিরমিজি : ৩৫৯৮)
তাই মানুষের সঙ্গে কারণে হোক আর অকারণে, কোনোভাবেই অন্যায় আচরণ, জুলুম-অত্যাচার করা যাবে না। মানুষের প্রতি জুলুম-অত্যাচার সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। এ কারণেই অত্যাচারিত ব্যক্তির আবেদন-নিবেদন আল্লাহ তাআলার দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়। আল্লাহ তাআলার মাজলুমের চাওয়া-পাওয়া খুবই দ্রুততার সঙ্গে কবুল করে থাকেন। সুতরাং মানুষের উচিত, দুনিয়ার কোনো সৃষ্টির প্রতিই জুলুম অত্যাচার না করা।
জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। অন্যের ওপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। আপদ-বিপদ ও দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জুলুম। তাই আল্লাহ তাআলা সবাইকে তা থেকে নিষেধ করেছেন।
এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩৭)
মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করা এবং তা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
জুলুমের শাস্তি : আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এমন এক অপরাধ যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালেমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করেন। সূরা আশ শোয়ারার শেষ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জুলুমবাজরা তাদের জুলুমের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কেমন?’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা জালেমকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপতিরোধ্য। (বোখারি ও মুসলিম)
জুলুম সম্পর্কে কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে।’ (সূরা হূদ : ১১৩)
আল্লাহ তাআলা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’ (সুরা আন নাহল : ৯০)
পবিত্র কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘জালেমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে কর না। তবে তিনি তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন চক্ষুগুলো বিস্ফোরিত হবে, তারা মাথা ঊর্ধ্বমুখী করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হৃদয়গুলো দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আজাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও, যেদিন তাদের কাছে আজাব আসবে। সেদিন জুলুমবাজরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! অল্প সময়ের জন্য আমাদের অবকাশ দিন, তাহলে আমরা আপনার ডাকে সাড়া দেব (অন্যের ওপর জুলুম করব না) এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। তোমরা কি এর আগে কসম খেয়ে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করছ এবং সেসব জালেমের সঙ্গে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪২-৪৫)
মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা অনেক বড় জুলুম। এই ধরনের জুলুমের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। বিত্তবানরা দারিদ্র্য শ্রেণিকে ও ক্ষমতাবানরা সাধারণ লোকের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন, নিপীড়ন করে। ফলে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ-আপদ। যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন।’ (মুসলিম : ২৬১৩)।
পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুলুমের ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা আশ শু‘আরা : ২২৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফল হয় না।’ (সুরা আল আন‘আম : ৫৭)
জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি : ২৫১১)
সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। একে অপরের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ।’ (সুরা আর রূম : ৪১)
মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। তাই মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি : ৩৫৯৮)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা মজলুমের দোয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কেননা মহান আল্লাহ ও তার দোয়ার মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’ (বুখারি : ১৪৯৬)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাদের জালিমদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেন এবং মজলুমের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন