বিটিবি নিউজ ডেস্ক: বাড়ি-ঘরের মায়া মনের মধ্যে রেখেই স্বজনদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে জড়ো হয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে; আতঙ্কের রাত পেরিয়ে সকালের ভাগেও প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর দাপট চলতে থাকায় আর ফেরা হয়নি। বিকালের দিকে বৃষ্টি মাথায় উপকূলবাসীদের অনেকে যখন ফিরেছেন নিজেদের প্রিয় আঙ্গিনায় ঝড়ের তাণ্ডবের নানা ক্ষতচিহ্ন দেখতে হয়েছে তাদের।
একশ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের বেগ নিয়ে ধেয়ে আসা ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আর ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু বানের তোড়ে ধ্বসে পড়েছে অনেকের ঘর; গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘর, নিচু এলাকার বাড়ি ডুবেছে পানিতে আর ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপকূলজুড়ে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ঝড়ের তান্ডবে রেখে যাওয়া বিষ দাঁতের ক্ষতগুলো।
ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠা এই ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর তাণ্ডবে উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলার শতাধিক উপজেলা। ঝড় উপকূল পার হওয়ার সময় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে; জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ।
জোয়ারের সময় ঝড়ের তোপ বাড়িয়েছে ক্ষতি; উপকূলের একের পর এক এলাকায় বেড়িবাধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম, ভেসে গেছে মাছের ঘের।
সোমবার ঘূর্ণিঝড়ের শেষটায় এবং রোববার উপকূলের কাছাকাছি আসার পর থেকে বানের জলে ভেসে, দেয়াল ও গাছ চাপায়, আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে ছয় জেলায় এক নারী ও শিশুসহ অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সরকারি হিসাবেই ধ্বংস হয়েছে ৩৫ হাজার বাড়িঘর।
প্রতিবেশী ভারতেও প্রাণহানির কারণ হয়েছে রেমাল। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি ঝড়ো বাতাসে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার।
ঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে আরও কিছু।
গত ২২ মে পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ দশা পেরিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় শনিবার সন্ধ্যায়। তখন এর নাম দেওয়া হয় রেমাল। রোববার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে।
এর প্রভাবে রোববার বিকাল থেকেই উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। পরদিন সকাল থেকে সারাদেশেই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেড়ে দুর্বল হয়ে আসে রেমাল।
সোমবার ঝড়ের দাপট কমে এলে আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা স্বজনদের বাড়ি থেকে যখন তারা নিচু এলাকায় নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন, তখন দেখতে পেয়েছেন বিধ্বস্ত ঘর, ভাঙা বাড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের, পানির তোড়ে বাধ ভেঙে ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত।
ক্ষতির পাশাপাশি প্রায় দুই দিন থেকে ভোগান্তিও কম ছিল না উপকূলবাসীর। ঝড়ের কারণে বড় বিপর্যয় এড়াতে আগের দিনেই বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছিল অনেক এলাকায়; অন্ধকারে ডুবে ছিলেন ৩০ লাখ গ্রাহকের পরিবার। ঝড় আঘাত হানার পর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পৌনে তিন কোটি। বিদ্যুৎহীন অবস্থা সবখানে রাতেই কাটছে না।
বিদ্যুৎ না থাকায় আস্তে আস্তে মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের আতঙ্কের মধ্যে স্বজনদের অবস্থা জানতে না পারার উৎকণ্ঠাও সঙ্গী হয়েছিল তাদের। সংবাদ সংগ্রহে ঢাকা থেকে উপকূলের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগেও বেগ পেতে হয়।
দীর্ঘ সময়জুড়ে চলা রেমালের তাণ্ডবে রাস্তায় গাছ পড়ে থাকায় অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে।
শুধু গ্রাম নয়, জেলা শহর ও নগরী ডুবিয়ে মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। বরিশাল নগরীও ডুবেছে বানের পানিতে।
সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনাসহ কয়েক জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম। খুলনার দাকোপ ও কয়রা এলাকায় অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের; ভেঙে গেছে কয়েক’শ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।
অন্যদিকে উপকূলের জেলাগুলোর মত বানের পানিতে না ডুবলেও টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে।
ঝড়ে উপকূলের আরেক বড় নগরী খুলনার অবস্থায় শোচনীয়। ভারি বৃষ্টিতে নগরের খুলনার অধিকাংশ সড়ক ও নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। অনেক বাড়ির নিচতলা ও দোকানঘরও পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি এবং আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি।
ঝড়ে বিতরণ লাইন লণ্ডভণ্ড হয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে দুই কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন; এর মধ্যে কেবল পল্লী বিদ্যুতের বিতরণ এলাকায় রয়েছেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৫০ জন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আগে-পরে বিদ্যুৎ না থাকায় ৬৪ জেলার ২২ হাজার মোবাইল সাইট (টাওয়ার) অচল হয়ে পড়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর পাশাপাশি দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও অনেক মোবাইল সাইট বন্ধ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ঝুঁকিতে ৩২ লাখ শিশু
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এতে ৮৪ লাখের বেশি মানুষ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৩২ লাখ শিশু। সোমবার (২৭ মে) এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফ প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ে ভোলা, পটুয়াখালী ও বাগেরহাট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের একমাত্র প্রচেষ্টা, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশু ও তাদের পরিবারের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের শুরু থেকেই মাঠে রয়েছে ইউনিসেফ। এ সময় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রাথমিক সতর্কতামূলক প্রচারণা ও প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে সর্বাত্মক সহায়তা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটি ও আশ্রয়কেন্দ্রে বিতরণের জন্য ইউনিসেফ দেশব্যাপী ৩৫টি গুদামে পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, জেরিক্যান, মোবাইল টয়লেট, স্বাস্থ্যবিধি (হাইজিন) ও পরিবারের জন্য উপযোগী (ফ্যামিলি) কিটসহ বিভিন্ন সামগ্রী মজুত করে রেখেছে।
এছাড়া, আমাদের দুটি সেবাপ্রদানকারী দল (র্যাপিড রেসপন্স টিম) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমরা সরকার ও অংশীজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। পাশাপাশি প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তা ও ত্রাণ দিতে সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করছি। আমাদের অগ্রাধিকার হলো সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবন রক্ষা করা ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা; বিশেষ করে শিশুদের, যারা এই ধরনের দুর্যোগের সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন