বিটিবি নিউজ ডেস্ক: আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস প্রকৃতির একটি অমূল্য দান। অক্সিজেন, যা আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য, তা প্রকৃতি থেকেই আসে। গাছপালা সেই অক্সিজেনের প্রধান উৎস। তবে, আমরা কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, আমাদের সারা জীবনের অক্সিজেনের প্রয়োজন মেটাতে প্রকৃতির কতটুকু সম্পদ ব্যয় হয়? আর সেই ব্যয় মেটাতে আমরা কী ভূমিকা পালন করছি? ন্যায়নিষ্ঠ একজন মানুষ যদি এই তথ্য সম্পর্কে সচেতন হন, তবে তার মন ও চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব পড়বে। চলুন, এই বিষয়টি নিয়ে একবার চিন্তা করি।
আপনি কি জানেন, একজন মানুষের সারা জীবনের অক্সিজেনের চাহিদা কতটুকু? গড়পড়তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিনে প্রায় ৫৫০ লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করে। যদি একজন মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর ধরা হয়, তাহলে সারা জীবনে তার প্রয়োজন পড়ে প্রায় ১৪ লাখ ৫ হাজার ২৫০ লিটার অক্সিজেন। এই বিশাল পরিমাণ অক্সিজেন উৎপন্ন করতে প্রয়োজন প্রায় ১৭টি পূর্ণবয়স্ক গাছ। এই হিসাবটি আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি কত বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন আসে, আমরা কি আমাদের জীবনের এই অক্সিজেনের জন্য প্রকৃতিকে কিছু ফিরিয়ে দিচ্ছি?
একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১১৮ কেজি অক্সিজেন উৎপাদন করে, যা প্রায় ৮২ হাজার ৬০০ লিটার অক্সিজেনের সমান। যদি আমরা জানি যে, আমাদের জীবনের অক্সিজেনের জন্য ১৭টি গাছ প্রয়োজন, তাহলে আমাদের এই গাছগুলোর যত্ন নেওয়া এবং তাদের রোপণের দায়িত্ব নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে, সব গাছই তো বেঁচে থাকে না। গাছগুলোকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আমাদের উচিত সারা জীবনে অন্তত ১০০টি গাছ লাগানো। এর থেকে অন্তত ১৭টি গাছ বেঁচে থাকবে এবং আমাদের প্রয়োজন মেটাবে।
এটা আমাদের ন্যায়নিষ্ঠতার শিক্ষাও দেয়। কারণ, ন্যায়নিষ্ঠ একজন মানুষ কখনোই চাইবেন না যে তিনি অন্যের অক্সিজেনে ভাগ বসান। তাই তিনি নিজেই তার প্রয়োজনীয় গাছ লাগানোর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি জানেন, গাছ লাগানো মানে শুধু নিজের প্রয়োজন মেটানো নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর
পৃথিবী রেখে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা। এভাবেই তিনি প্রকৃতির প্রতি তার ঋণ শোধ করতে পারেন। কবি কামিনী রায় বলেছেন, 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' এই বাক্যটি আমাদের শেখায় যে, আমাদের কাজ শুধু নিজেদের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও হতে হবে। যদি আমরা প্রতিটি মানুষ অন্তত ১০০টি করে গাছ লাগাই, তবে আমরা শুধু আমাদের নিজেদের চাহিদাই পূরণ করব না, বরং অন্যের জীবনেও অবদান রাখব।
গাছ লাগানোর উপকারিতা অল্প কথায় প্রকাশ সম্ভব নয়। গাছ লাগানো শুধু অক্সিজেন উৎপাদনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি আরো অনেক উপকার করে। গাছ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং বায়ু থেকে দূষিত উপাদান সরিয়ে ফেলে। এটি মাটি রক্ষা করে, পানি ধরে রাখে এবং প্রাণীদের আশ্রয়স্থল সরবরাহ করে। এছাড়া গাছ পরিবেশের উষ্ণতা কমায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। যদি আমরা প্রত্যেকে এই গুরুত্ব বুঝে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিই, তবে আমাদের পরিবেশ আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
প্রকৃত অর্থে, বৃক্ষরোপণ একটি পবিত্র কাজ, যা আমাদের ন্যায়নিষ্ঠতার শিক্ষা দেয়, সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় দেয়। এটি কেবল একটি কাজ নয়, বরং এটি একটি চর্চা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শ হতে পারে। আপনি যদি সারা জীবনে ১০০টি গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে সেটি আপনার একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে। এটি করার জন্য আপনাকে পরিকল্পিত হতে হবে। প্রথমত, গাছ রোপণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই গাছগুলোর যত্ন
নিতে হবে, যাতে তারা বড় হতে পারে। তৃতীয়ত, এই দায়িত্বের কথা অন্যদের জানাতে হবে এবং তাদেরকেও এই কাজে উৎসাহিত করতে হবে।
গাছ লাগানো শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও। আমরা যদি আমাদের বন্ধু, পরিবার এবং প্রতিবেশীদের এই কাজে উদ্বুদ্ধ করি, তবে একটি বৃহত্তর পরিবেশগত আন্দোলন শুরু হতে পারে। একটি গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয় না, এটি আমাদের সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটি প্রমাণ করে যে, আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, বরং পৃথিবীর জন্যও কাজ করছি। একসঙ্গে কাজ করলে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব এবং এটি আমাদের ন্যায়নিষ্ঠতাকে আরো দৃঢ় করে।
আরো একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আমাদের দায়িত্ব শুধু নিজেদের জন্য নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও। একটি সবুজ পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। আমরা যদি আজ গাছ লাগাই, তবে আমাদের সন্তানরা একটি পরিচ্ছন্ন এবং বাসযোগ্য পৃথিবী পাবে। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্বের অংশ। শুধু তা-ই নয়, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা করবে। আমাদের ছোট ছোট কাজই বড় পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। বৃক্ষরোপণ একটি প্রতীক, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানিয়ে দেয় যে, আমরা তাদের জন্য একটি ভালো পৃথিবী রেখে যেতে চাই।
বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের জীবনে বড় হুমকি সৃষ্টি করছে। গাছ এই সমস্যাগুলোর সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছ মাটির ক্ষয় রোধ করে, ঝড় ও বন্যার প্রভাব কমায় এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে। যদি আমরা আজ যথেষ্ট গাছ লাগাই, তবে ভবিষ্যতে এই সমস্যাগুলো অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে।
সুতরাং উপসংহারে আমরা বলতে পারি, একজন মানুষ তার সারা জীবনের অক্সিজেনের প্রয়োজন মেটাতে গাছের ওপর নির্ভরশীল—তবে শুধু বৃক্ষ রোপণ করাই যথেষ্ট নয়; আমাদের সেই গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছ আমাদের জীবন দেয়, আমাদের পরিবেশকে সুন্দর করে। তাই আমাদের উচিত, এই মহৎ কাজটি করা এবং অন্যদেরও এই কাজে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা যদি নিজেদের জন্য ১০০টি গাছ লাগাই, তবে আমরা কেবল নিজেদেরই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অবদান রাখব।
‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' কবির এই চিন্তাধারা যদি আমাদের সবার মধ্যে জাগ্রত হয়, তবে আমরা একটি সবুজ, পরিচ্ছন্ন এবং সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব। সুতরাং আমরা প্রতিজ্ঞা করি, প্রকৃতির কাছে আমাদের ঋণ শোধ করার জন্য গাছ লাগাব। এটি আমাদের একটি ছোট পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু এর ফলাফল হবে চিরস্থায়ী।
সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাস
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
সূত্র: ইত্তেফাক